ভারতচন্দ্র
প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)
১।
‘ভারতচন্দ্র’ প্রবন্ধটি যে গ্রন্থের অন্তর্গত তা হল- ‘নানাচর্চা’।
২।
‘ভারতচন্দ্র’ প্রবন্ধটি শ্রাবণ, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ।
৩।
‘ভারতচন্দ্র’ প্রবন্ধটি শান্তিপুর সাহিত্য-সম্মিলনীতে সভাপতির অভিভাষণ হিসেবে পাঠ
করেন।
৪।
‘ভারতচন্দ্র’ প্রবন্ধটিতে মোট পরিচ্ছেদ সংখ্যা ১৪টি।
৫। বাংলা
ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের অনুরক্ত ভক্তবৃন্দ যে লেখককে তাঁদের সম্প্রদায়ভুক্ত মনে
করেন, তা লেখকের পক্ষে কম সৌভাগ্যের কথা নয়।
৬।
ভারতচন্দ্র বলেছেন-
যার কর্ম তারে সাজে অন্য লোকে লাঠি বাজে
৭। লেখক
এরকম অধিকাংশ নিমন্ত্রণই রক্ষা করতে পারেন না সেটা অনেকটা- The spirit is willing, but the flesh is weak-এর মতো।
৮।
শান্তিপুরের নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করতে না পারার পেছনে লেখক ২টি কারণ দেখিয়েছেন।
৯। সম্প্রতি
কোনো সমালোচক আবিষ্কার করেছেন লেখক নাকি এ যুগের ভারতচন্দ্র।
১০। এ
প্রবন্ধ যখন লেখা হয় তার প্রায় ১৮০ বছর আগে ভারতচন্দ্র ইহলোক ত্যাগ করেন।
১১। লেখকের
মতে আজ থেকে ১৮০ বছর পর রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত তাঁদের সময়ের প্রায় কোনো সাহিত্যিকই
কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন না।
১২। সকল
দেশেই এমন দু-একজন থাকেন যাঁরা লোকমতে যুগপৎ বড়ো লেখক ও দুষ্ট লেখক। উদাহরণ স্বরূপ
লেখক ইতালির মাকিয়াভেলি নাম করেন (মাকিয়াভেলি The Prince-এর রচয়িতা)। ভারতচন্দ্র নামটিও উক্ত শ্রেণিভুক্ত হয়ে পড়েছে বলে লেখকের বিশ্বাস। লেখক
ভারতচন্দ্রের এই দুর্নামের সত্যতা যাচাই করতে চেয়েছেন এই প্রবন্ধে।
১৩।
ভারতচন্দ্র নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন-
ভুরিশিটে
মহাকায় ভূপতি নরেন্দ্র রায়
মুখটি
বিখ্যাত দেশে দেশে।
ভারত তনয় তাঁর অন্নদামঙ্গল সার কহে কৃষ্ণচন্দ্রের
আদেশে॥
১৪।
ভারতবর্ষের দক্ষিণাপথে Non-Brahmin Movement নামে
আন্দোলন চলছে রাজনীতির ক্ষেত্রে। লেখক এই আন্দোলনের পক্ষপাতী।
১৫।
সমালচকের মতে লেখকের পক্ষে একে ব্রাহ্মণ তার ওপর ভূসম্পন্ন হওয়াটা, একে মনসা তায়
ধুনোর গন্ধ জাতীয় ব্যাপার।
১৬। মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল (অভয়ামঙ্গল) কাব্যের
সূচনায় বলেছেন-
দামুন্যায় চাষ চষি।
১৭।
সমালোচকদের মতে লেখকের জীবন হল ট্রাজেডি।
১৮। লেখকের
মতে, ভারতচন্দ্রের সাংসারিক জীবন ছিল সত্যই একটি অসাধারণ ট্রাজেডি। তাঁর জীবন
সত্যিই ডিভাইন কমেডি।
১৯। ১৩০২
শতাব্দে দ্বারকানাথ বসু কর্তৃক প্রকাশিত ‘কবির জীবনী সম্বলিত’ গ্রন্থাবলীর
প্রস্তাবনা অংশ থেকে লেখক ভারতচন্দ্রের জীবনী সংগ্রহ করেন।
২০। ভারতচন্দ্রের
সংক্ষিপ্ত জীবনী-
১৭১২ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার অন্তর্গত পেঁড়ো গ্রামে ভারতচন্দ্র জন্মগ্রহণ
করেন। পিতা নরেন্দ্রনাথ রায় ভূরসুট পরগণার অধিপতি ছিলেন। বর্ধমান অধিপতির সাথে
বিবাদে তিনি সর্বস্বান্ত হন। ভারতচন্দ্রের বয়স তখন ১১ বছর। বিদ্যাশিক্ষায় উৎসাহী
বালক বাড়িতে শিক্ষার অসুবিধের জন্য ‘পলায়নপূর্বক’ মামাবাড়ি যায়। এবং সেখানে
যত্নসহকারে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও অভিধান অধ্যয়ন করে ১৪ বছর বয়সে বাড়ি ফিরে আসে। তারপর
তাঁর বিবাহ হয়। অর্থকরী পারস্য ভাষা না শিখে অনর্থকরী সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করার
জন্য দাদাদের কাছে ভর্ৎসিত হলে ভারতচন্দ্র পুনরায় গৃহত্যাগ করেন। তারপর
দেবানন্দপুর গ্রামের জমিদার রামচন্দ্র মুনশির আশ্রয়ে অত্যন্ত পরিশ্রম করে তিনি
পারস্য ভাষা অধ্যয়ন করেন। এরপর ২০ বছর বয়সে তিনি বাড়ি ফেরেন। এইসময়
আত্মীয়-স্বজনেরা তাঁর অসাধারণ বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে দরবার করার জন্য তাঁকে মোক্তার
হিসেবে বর্ধমান রাজসভায় পাঠান। সেখানে তিনি কর্মচারীদের চক্রান্তে কারারুদ্ধ হন।
কারাধক্ষ্যের কৃপায় জেল থেকে পালিয়ে কিছুদিন
মারহাট্টাদের আশ্রয়ে বাস করেন তারপর শ্রীক্ষেত্রে বৈষ্ণবদের বাস করেন। এইসময় তিনি
শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণবগ্রন্থনিচয় পাঠ করেন। এরপর বৃন্দাবনধাম দর্শনের জন্য তিনি
শ্রীক্ষেত্র থেকে পদব্রজে বৃন্দাবন যাত্রা করেন। পথমধ্যে খানাকুল কৃষ্ণনগর গ্রামে
তাঁর শ্যালীপতি ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার অনুরোধে পুনরায় সংসারী হন।
অর্থোপার্জনের জন্য ফরাসডাঙ্গার দুপ্নে সাহেবের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে
আশ্রয় নেন। কিছুদিন পর নবদ্বীপ অধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র টাকা ধার করার জন্য
ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সাথে দেখা করতে আসেন, তখন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর অনুরোধে
ভারতচন্দ্র মাসিক ৪০ টাকা মাইনেতে কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ হিসেবে নিযুক্ত হন।
এইসময় তিনি ‘অন্নদামঙ্গল’ রচনা করেন। রাজা
কৃষ্ণচন্দ্র অন্নদামঙ্গল শুনে প্রীত হয়ে ভারতচন্দ্রকে মূলাজোড় গ্রাম ইজারা দেন এবং
সেখানে বাড়ি তৈরির জন্য ১০০ টাকা দেন। এই গ্রামেই ৪৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
২১।
ভারতচন্দ্র তাঁর জীবনের শেষবয়সের ক’টা দিনের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে-
গতে
রাজ্যে কার্যে কুলবিহিতবীর্যে পরিচিতে
ভবদ্দেশে
শেষে সুরপুরবিশেষে কথমপি।
স্থিতং
মূলাজোড়ে ভবদনুবলাৎ কালহরণং
সমস্তং মে নাগো গ্রসতি সবিরাগো হরি হরি॥
বয়শ্চত্বারিংশত্তব
সদসি নীতং নৃপ ময়া
কৃতা
সেবা দেবাদধিকমিতি মত্বাপ্যহরহঃ।
কৃতাবাটী গঙ্গাভজনপরিপাটী পুটকিতা
সমস্তং
মে নাগো গ্রসতি সবিরাগো হরি হরি॥
পিতা বৃদ্ধঃ পুত্রঃ শিশুরহহ নারী বিরহিণী
হতাশাদাসাদ্যাশ্চকিতমনসো
বান্ধবগণাঃ।
যশঃ শাস্ত্রং শস্ত্রং ধনমপি চ বস্ত্রং চিরচিতং
সমস্তং মে
নাগো গ্রসতি সবিরাগো হরি হরি॥
২২। অন্নদামঙ্গল কাব্যে ভারতচন্দ্র স্ত্রীর মুখে পতিনিন্দা করাচ্ছেন-
তা সবার দুঃখ শুনি কহে এক সতী।
অপূর্ব আমার দুঃখ কর অবগতি॥
মহাকবি মোর পতি কোট রস জানে।
কহিল বিরস কথা সরস বাখানে॥
পেটে অন্ন হেটে বস্ত্র জোগাইতে নারে।
চালে খড় বাড়ে মাটি শ্লোক পড়ি সারে॥
নানাশাস্ত্র জানে কত কাব্য অলঙ্কার।
কত মতে কত বলে বলিহারি তার॥
শাঁখা সোনা রাঙা শাড়ি না পরিনু কভু।
কেবল কাব্যের গুণে প্রমোদের প্রভু॥
২৩। লেখকের মতে, যথার্থ আর্টিস্টের মন সকল দেশেই সংসারে নির্লিপ্ত, কস্মিন্কালেও
বিষয়বাসনায় আবদ্ধ নয়।
২৪। ইউরোপে দ্বিতীয় শেক্সপীয়ার বলে পরিচিত সের্ভান্তেসের (Cervantes) জীবন ছিল বিষম দুঃখময় অথচ তাঁর সাহিত্যজগৎ
চির-আলোকিত।
২৫। ভারতচন্দ্রের মতে সে-ই সংসারের দুঃখকে অতিক্রম করে বীরের হাসি হাসতে পারে-
চেতনা যাহার চিত্তে সেই চিদানন্দ॥
যে জন চেতনামুখী সেই সদা সুখী।
যে জন অচেতনচিত্ত সেই সদা দুখী॥
২৬। প্রাবন্ধিকের মতে, অন্নদামঙ্গল, মানসিংহ, সত্যনারায়ণের পুথি প্রভৃতিতে
ভারতচন্দ্র যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন তার উপর ও কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করে ঈশ্বর গুপ্ত
প্রমুখ ভারতচন্দ্রের জীবনী রচনা করেছেন।
২৭। এই প্রবন্ধ রচনার ১০-১২ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে দার্জিলিং শহরে বঙ্গ
সাহিত্যের ইতিহাস সম্বন্ধে ইংরেজি ভাষায় একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেখানে
তিনি ভারতচন্দ্র সম্পর্কে বলেন-
Bharatchandra, as a supreme literary craftsman, will ever remain a master
to us writers of the Bengali language.
২৮। প্রাবন্ধিকের মতে, ভারতচন্দ্র চেয়েছিলেন যে, তাঁর কাব্যে প্রসাদগুণ থাকবে
ও তা হবে রসালো। এ দুই বিষয়েই তাঁর মনস্কামনা সিদ্ধ হয়েছে। গোল তো এইখানেই। যে রস
তাঁর কাব্যের একটি বিশেষ রস সে রস এ যুগে অস্পৃশ্য। কেননা তা হচ্ছে আদিরস।
২৯। বিদ্যাসুন্দর রচনা করলেও রামপ্রসাদকে আমরা সেই পরিমাণ অশ্লীল মনে করি না
কারণ তাঁর কাব্য অত জনপ্রিয় নয়।
৩০। ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতার ভিতর art
আছে, অপরের কাছে শুধু nature।
৩১। ভারতচন্দ্রের সাহিত্যের প্রধান রস, আদিরস নয়, হাস্যরস।
৩২। আমাদের শিক্ষাগুরুদের মতে বাঙালি জাতির জন্ম ইংরেজ আগমনের পর অর্থাৎ ১৭৫৭
সাল থেকে।
৩৩। প্রাবন্ধিক প্রবন্ধের শেষ করেছেন ভারতচন্দ্রের রচনার অংশ দিয়েই-
সেই আজ্ঞা
অনুসরি কথা শেষে ভয় করি
ছল ধরে পাছে
খল জন।
রসিক পণ্ডিত
যত, যদি দেখো দুষ্ট মতো
সারি দিবা
এই নিবেদন।
No comments:
Post a Comment