মেঘদূত
গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি:
১। রামগিরি হইতে হিমালয় পর্যন্ত প্রাচীন
ভারতবর্ষের যে দীর্ঘ এক খণ্ডের মধ্য দিয়া মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা ছন্দে জীবনস্রোত প্রবাহিত হইয়া
গিয়াছে,
সেখান হইতে কেবল বর্ষাকাল নহে, চিরকালের মতো আমরা নির্বাসিত হইয়াছি।
২। গ্রামের প্রান্তে জম্বুবনে ফল পাকিয়া মেঘের মতো কালো হইয়াছিল, সেই দশার্ণ কোথায় গেল! আর, সেই-যে অবন্তীতে গ্রামবৃদ্ধেরা উদয়ন এবং বাসবদত্তার গল্প বলিত, তাহারাই বা কোথায়! আর, সেই সিপ্রাতটবর্তিনী উজ্জয়িনী!
৩। আবার সেই প্রাচীন ভারতখণ্ডটুকুর নদী-গিরি-নগরীর নামগুলিই বা কী সুন্দর! অবন্তী বিদিশা উজ্জয়িনী, বিন্ধ্য কৈলাস দেবগিরি, রেবা সিপ্রা বেত্রবতী। নামগুলির মধ্যে একটি শোভা সম্ভ্রম শুভ্রতা আছে। ...মনে হয়, ঐ রেবা-সিপ্রা-নির্বিন্ধ্যা
নদীর তীরে অবন্তী-বিদিশার
মধ্যে প্রবেশ করিবার কোনো পথ যদি থাকিত তবে এখনকার চারি দিকের ইতর কলকাকলি হইতে
পরিত্রাণ পাওয়া যাইত।
৪। সেই কবির ভারতবর্ষ যেখানকার জনপদবধূদিগের
প্রীতিস্নিগ্ধলোচন ভ্রূবিকার শিখে নাই এবং পুরবধূদিগের ভ্রূলতাবিভ্রমে-পরিচিত
নিবিড়পক্ষ্ণ কৃষ্ণনেত্র হইতে কৌতূহলদৃষ্টি মধুকরশ্রেণীর মতো ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত
হইতেছে, সেখান হইতে আমরা বিচ্যুত হইয়াছি– এখন কবির মেঘ ছাড়া
সেখানে আর কাহাকেও দূত পাঠাইতে পারি না।
৫। মনে
পড়িতেছে কোনো ইংরেজ কবি লিখিয়াছেন, মানুষেরা এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, পরস্পরের মধ্যে অপরিমেয় অশ্রুলবণাক্ত
সমুদ্র।
৬। আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের নিবিড় ঐক্য আছে, অথচ কালের নিষ্ঠুর ব্যবধান।
৭। কবির কল্যাণে এখন সেই অতীতকাল অমর সৌন্দর্যের অলকাপুরীতে পরিণত হইয়াছে; আমরা আমাদের
বিরহবিচ্ছিন্ন এই বর্তমান মর্তলোক হইতে সেখানে কল্পনার মেঘদূত প্রেরণ করিয়াছি।
৮। কিন্তু
কেবল অতীত বর্তমান নহে,
প্রত্যেক মানুষের
মধ্যে অতলস্পর্শ বিরহ। আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে
আপনার মানসসরোবরের অগম তীরে বাস করিতেছে; সেখানে কেবল
কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেখানে সশরীরে উপনীত হইবার কোনো পথ
নাই।
৯। ভিত্ত্বা সদ্যঃ কিসলয়পুটান্ দেবদারুদ্রুমাণাং
যে তৎক্ষীরস্রুতিসুরভয়ো দক্ষিণেন প্রবৃত্তাঃ।
আলিঙ্গ্যন্তে গুণবতি ময়া তে তুষারাদ্রিবাতাঃ
পূর্বং স্পৃষ্টং যদি কিল ভবেদঙ্গমেভিস্তবেতি॥
যে তৎক্ষীরস্রুতিসুরভয়ো দক্ষিণেন প্রবৃত্তাঃ।
আলিঙ্গ্যন্তে গুণবতি ময়া তে তুষারাদ্রিবাতাঃ
পূর্বং স্পৃষ্টং যদি কিল ভবেদঙ্গমেভিস্তবেতি॥
এই চিরবিরহের কথা উল্লেখ
করিয়া বৈষ্ণব কবি গাহিয়াছেন–
দুঁহু কোলে দুঁহু
কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
১০। আমরা
প্রত্যেকে নির্জন গিরিশৃঙ্গে একাকী দণ্ডায়মান হইয়া উত্তরমুখে চাহিয়া আছি; মাঝখানে আকাশ এবং
মেঘ এবং সুন্দরী পৃথিবীর রেবা
সিপ্রা অবন্তী উজ্জয়িনী,
সুখ সৌন্দর্য-ভোগ-ঐশ্বর্যের চিত্রলেখা– যাহাতে মনে করাইয়া দেয়, কাছে আসিতে দেয় না–
আকাঙক্ষার উদ্রেক করে, নিবৃত্তি করে না। দুটি মানুষের মধ্যে এতটা দূর!
১১। কিন্তু এ
কথা মনে হয়, আমরা যেন কোনো-এক কালে একত্র এক মানসলোকে ছিলাম, সেখান
হইতে নির্বাসিত হইয়াছি। তাই বৈষ্ণব কবি বলেন : তোমায় হিয়ার ভিতর হইতে কে কৈল বাহির! এ কী হইল! যে আমার
মনোরাজ্যের লোক,
সে আজ বাহিরে আসিল কেন! ওখানে তো তোমার স্থান নয়।
১২। বলরামদাস
বলিতেছেন : তেঁই বলরামের, পহু, চিত নহে স্থির।
·
প্রকাশকাল- অগ্রহায়ণ, ১২৯৮
·
মূলগ্রন্থ- প্রাচীন সাহিত্য (১৩১৪বঙ্গাব্দ, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ)
·
সাহিত্য পত্রিকায়
প্রকাশিত।
·
কবির জীবৎকালে প্রাচীন সাহিত্য গ্রন্থটি ৭ বার পুনর্মুদ্রিত হয়।
No comments:
Post a Comment