বাংলা শব্দভাণ্ডার (Bengali Vocabulary):
বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে উৎসগত বিচারে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
১। মৌলিক বা নিজস্ব ২। আগন্তুক বা কৃতঋণ ৩। নবগঠিত
১। মৌলিক বা নিজস্ব: যে সকল শব্দ
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা (বৈদিক ও সংস্কৃত) থেকে উত্তরাধিকার-সূত্রে বাংলায় এসেছে
তাদের মৌলিক শব্দ বলা হয়। মৌলিক শব্দকে আবার তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
ক) তৎসম খ) অর্ধ তৎসম গ) তদ্ভব
ক) তৎসম- যে সকল শব্দ প্রাচীন ভারতীয়
আর্যভাষা থেকে অপরিবর্তিতভাবে বাংলায় এসেছে সেগুলিকে বলা হয় তৎসম শব্দ। তৎসম
শব্দকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-
অ) সিদ্ধ তৎসম- যেগুলিকে বৈদিক ও সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় ও ব্যাকরণ সিদ্ধ।
যেমন- সূর্য, কৃষ্ণ, নর, মিত্র, লতা ইত্যাদি।
আ) অসিদ্ধ তৎসম- বৈদিক ও সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় না এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ
সিদ্ধ নয় অথচ প্রাচীনকালে মৌখিক সংস্কৃতে প্রচলিত ছিল, অধ্যাপক সুকুমার সেন
সেগুলিকে ‘অসিদ্ধ তৎসম’ বলেছেন। যেমন- কৃষাণ, ঘর, ডাল (বৃক্ষশাখা) ইত্যাদি।
খ) অর্ধ তৎসম- যেসব শব্দ প্রাচীন
ভারতীয় আর্যভাষা থেকে মধ্যবর্তী স্তর প্রাকৃতের মাধ্যমে না এসে সরাসরি বাংলায়
এসেছে এবং আসার পোড়ে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়েছে তাদের অর্ধ তৎসম বা ভগ্ন
তৎসম শব্দ বলা হয়। যেমন- কৃষ্ণ > কেষ্ট, নিমন্ত্রণ > নেমন্তন্ন, ক্ষুধা >
খিদে, রাত্রি > রাত্তির ইত্যাদি।
গ) তদ্ভব- যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য থেকে
সোজাসুজি বাংলায় আসেনি, মধ্যবর্তী পর্বে প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তন লাভ করে
বাংলায় এসেছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলে। তদ্ভব শব্দকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-
অ) নিজস্ব তদ্ভব- যেসব শব্দ যথার্থই বৈদিক বা সংস্কৃতের নিজস্ব শব্দের
পরিবর্তনের ফলে এসেছে তাদের বলা হয় নিজস্ব তদ্ভব। যেমন- ইন্দ্রাগার > ইন্দাআর
> ইন্দারা, উপাধ্যায় > উবজ্ঝাঅ > ওঝা ইত্যাদি।
আ) কৃতঋণ তদ্ভব- যেসব শব্দ প্রথমে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষায় ইন্দো-ইউরোপীয়ের
অন্য ভাষাবংশের অন্য ভাষা থেকে বা ইন্দো-ইউরোপীয় ছাড়া অন্য ভাষাবংশ থেকে কৃতঋণ
হিসেবে এসেছিল পরে প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তন লাভ করে বাংলায় এসেছে তাদের কৃতঋণ
তদ্ভব বলা হয়। যেমন- গ্রিক দ্রাখ্মে > সংস্কৃত দ্রম্য > প্রাকৃত দম্ম >
বাংলা দাম, তামিল কাল > সংস্কৃত খল্প > প্রাকৃত খল্ল > বাংলা খাল ইত্যাদি।
২। আগন্তুক বা কৃতঋণ: যেসকল শব্দ সংস্কৃতের নিজস্ব উৎস থেকে বা অন্য ভাষা থেকে সংস্কৃত হয়ে আসেনি, সরাসরি বাংলায়
এসেছে তাদের বলে আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ (Loan words)। আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দকে আবার দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
ক) দেশি- যেসব শব্দ এদেশেরই, অন্য ভাষা থেকে
সরাসরি বাংলায় এসেছে তাদের বলা হয় দেশি শব্দ। দেশি শব্দকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত
করা হয়-
অ) আর্য- যেমন-
হিন্দি: কচুরি, লোটা, বন্ধ্, লাগাতার,
খানাপিনা, টালমাটাল, বাতাবরণ, সেলাম, দোস্ত, ওস্তাদ, মস্তান, জাঠা ইত্যদি। এগুলির
মধ্যে অনেকের মূল উৎস আরবি-ফারসি হলেও সেগুলি যেহেতু হিন্দি ভাষার মাধ্যমে বাংলায়
এসেছে তাই সেগুলিকে দেশি রূপে গ্রহণ করা হয়।
গুজরাতি: হরতাল, গরবা, তকলি, খাদি ইত্যাদি।
মারাঠি: পাটিল, কুলকার্নি, বর্গি, চৌথ
ইত্যাদি।
পাঞ্জাবি: চাহিদা, শিখ, খালসা, ধাবা ইত্যাদি।
আ) অনার্য- যেমন অস্ট্রিক: ডাব, ঢোল, ঢাক, ঢিল, ঢেঁকি, ঝাঁটা, ঝোল, ঝিঙ্গা,
কুলা ইত্যাদি।
খ) বিদেশি- যেসব শব্দ এদেশের বাইরে থেকে
অর্থাৎ অন্য কোনও দেশের ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে সেগুলিকে বিদেশি শব্দ বলে। যেমন-
ইংরেজি: স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, চেয়ার,
টেবিল, পেন, ফাইল কোট, হ্যাট, সিনেমা, টিকিট, থিয়েটার, রোম্যান্টিক, লাইব্রেরি,
লেকচারার, গ্রামোফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, কমিটি, ভিডিও, রেডিও, স্টেশন, ট্রেন,
ট্রাম, ইলেকট্রিক, ভোট, ব্যালট, হোটেল ইত্যাদি। বিকৃত আকারে গৃহীত ইংরেজি শব্দ- গারদ (Guard), লাট (Lord), ডাক্তার (Doctor), জাঁদরেল (general), আপিস (Office), আর্দালি (Orderly), কৌঁশুলি (Counsel), পুলিশ (Police), হাসপাতাল (Hospital) ইত্যাদি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত শব্দ বা শব্দসমষ্টি (Translation Loan)- বাতিঘর (Light-house), সুবর্ণ
সুযোগ (Golden opportunity), মুখপুস্তিকা (Facebook), হাত ঘড়ি (Wrist watch), পাদ প্রদীপ (Foot
light), মাতৃভূমি (Motherland), আমি আসতে পারি
কি? (May I come in?) ইত্যাদি।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের শব্দ যা প্রথমে ইংরেজিতে গৃহীত পরে তা বাংলায়
এসেছে। যেমন- বুমেরাং, ক্যাঙারু (অস্ট্রেলিয়া); শিম্পাঞ্জি, জেব্রা (দক্ষিণ
আফ্রিকা); কুইনাইন (দক্ষিণ আমেরিকা); চকোলেট (উত্তর আমেরিকা); জুজুৎসু, রিকশা, হারাকিরি, ইকাবেনা, সামুরাই, ইয়েন,
সুনামি (জাপান); স্টুডিও, ম্যালেরিয়া, ফ্রেস্কো, ফ্যাসিস্ত, টেরাকোটা, মাফিয়া,
ম্যাজেন্টা (ইতালি); ইয়াক, লামা, মোমো (তিব্বত); নাৎসি, কিন্ডারগার্টেন (জার্মানি);
ফুঙ্গি, লুঙ্গি (মায়ানমার); চা, চিনি, লিচু, চামচা (চিন); সোভিয়েত, বলশেভিক, ভড্কা,
স্পুটনিক, পেরেস্ত্রৈকা (রাশিয়া); এসপ্ল্যানেড (স্পেন), রোবট (চেকোস্লোভিয়া); ওরাং-ওটাং
(বোর্নিও) ইত্যাদি।
জার্মান: জার, নাৎসি ইত্যাদি।
পর্তুগিজ: আনারস, আলপিন, আলকাতরা, আলমারি,
আচার, আয়া, আতা, ইস্তিরি, ইস্পাত, কাবা, কাজু, কাকাতুয়া, কামরা, কামিজ, কপি (ফুলকপি),
ক্যানেস্তারা, ক্রুশ, কেদারা, কিরিচ, কামিজ, কেদারা, কেরানি, গরাদ, গামলা, গুদাম,
গির্জা, চাবি, জানালা, জোলাপ, চোকা, তামাক, তোয়ালে, তোলো (হাঁড়ি), নোনা, নিলাম, পরাত, পাচার,
পাদ্রি, পাঁউরুটি, পেঁপে, পেয়ারা, পেরেক, পিপে, পিস্তল, ফিতে, ফুঁদিল, বরগা, বয়া,
বালতি, বাসন, বারান্দা, বেহালা, বোতাম, বোমা, বোম্বেটে, মার্কা, মাস্তুল,
মিস্ত্রি, যিশু, রেস্ত, সাবান, সায়া, সালসা, সাগু, হার্মাদ ইত্যাদি।
ফরাসি: কার্তুজ, কুপন, মেনু, রেস্তোরাঁ,
দিনেমার, বুর্জোয়া, প্রোলেতারিয়েৎ, রেনেসাঁ, অ্যামেচার, গ্যারেজ, ম্যাটিনি, ব্যালে
ইত্যাদি।
স্পেনীয়: কমরেড ইত্যাদি।
ইতালীয়: কোম্পানি, গেজেট ইত্যাদি।
ওলন্দাজ: ইস্ক্রুপ, তুরুপ, হরতন, রুইতন,
ইস্কাবন ইত্যাদি।
ফারসি ও ফারসি বাহিত তুর্কি শব্দ: আগা,
আলখাল্লা, উজবুক, উর্দু, কলকা, কাঁচি, কাবু, কাগজ, কুলি, কোঁতকা, কোর্মা, খাতুন,
খান, খাঁ, খাঁন, গালিচা, চকমকি, চাকু, চাকর, চাকরি, চিক, তকমা, তুরুক, তোড়া, তোপ,
দারোগা, ডেকচি, বকশিশ, বাবুর্চি, বাহাদুর, বিবি, বেগম, বোঁচকা, মুচলেকা, লাশ,
সওগাত ইত্যাদি।
৩। নবগঠিত: এসব ছাড়া বাংলায়
কিছু নবগঠিত শব্দও আছে। নবগঠিত শব্দ দুই প্রকারের হয়ে থাকে-
অ) অবিমিশ্র শব্দ- যেমন- অনিকেত, অতিরেক ইত্যাদি।
আ) মিশ্র বা সঙ্কর শব্দ (Hybrid words)-
ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সহযোগে মিশ্র শব্দ গঠিত হয়। যেমন- হেড (ইংরেজি) + পণ্ডিত (বাংলা)=
হেডপণ্ডিত, ফি (ফরাসি) + বছর (বাংলা) = ফিবছর ইত্যাদি।
Our official facebook page: https://m.facebook.com/banglanetset
No comments:
Post a Comment